মোঃ আনিসুর রহিম
করোনা সংক্রমণ রোধে বিশ্বব্যাপী চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে মানবকুল উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারছে না। করোনা দুর্যোগ মানুষকে ঘরবন্দি করেছে। অপরদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষকে ঘরছাড়া করে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে।
আমরা কয়েকজন মিলে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনিসহ কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে এলাম। খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত এলাকার মানুষ কী অমানবিক জীবনযাপন করছে দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষ কিভাবে ঘরছাড়া তথা জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে তা পর্যবক্ষেণ করলাম।
সিডির, আইলা, ফণী, বুলবুল, আম্পান প্রভৃতি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ, দেবহাটা, তালা উপজেলার ২৫ হাজারের বেশি মানুষ বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়ে ঘরছাড়া হয়েছে।
২৯, ৩০, ৩১ মার্চ আকষ্মিকভাবে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের থেকে বেশি পানি আসায় শ্যামনগর উপজেলা ও আশাশুনি উপজেলার বিভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে লোনা পানি গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে দিয়েছে।
বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের দূর্গাবাটি গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত এলাকার মানুষ কী অমানবিক জীবনযাপন করছে দেখে হতবাক হয়ে গেলাম।
কোথায় কী ভাবে খাবার পানি যোগাড় করবে? শিশুদের জন্য মায়েদের হাহাকারের কথা ভাবা যায়? বেড়িবাঁধের একজায়গায় ভাঙার পর পাঁচ থেকে দশ গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সহায় সম্পদ, হাঁস মুরগী, গরু ছাগলের কী অবস্থা হয় ভাবা যায়? মৎস্যঘের আর পুকুরের মাছ রাতারাতি হারিয়ে যায়।
বারবার যখন একইভাবে দুঃখের ঘটনা ঘটে, তখন কীভাবে মানুষ আগের জীবনে ফিরে আসবে? গাবুরা ইউনিয়ন একটি ছোট দ্বীপ। পদ্মপুকুরও তেমনি একটি দ্বীপ। গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামের মানুষ আমাদের জানালেন, গেল দশ বছরে প্রায় আট হাজার মানুষ ইউনিয়নের মায়া ত্যাগ করে, সাজানো সংসার ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এদের মধ্যে ধনী লোকের সংখ্যা কম। প্রায় সবাই দরিদ্র পরিবারের মানুষ। কাজ নেই তো খাওয়া নেই। কীভাবে মানুষ টিকে থাকতে পারবে? ধনী লোকের পক্ষে বার বার দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে মানবেতর জীবন মেনে নিতে না পেরে তাঁরা দ্বিতীয় হোম হিসেবে ঢাকা বা খুলনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আর দরিদ্রও মানুষেরা সর্বহারা হয়ে শহরের বস্তিতে নতুন জীবনের সন্ধানে চলে যান। সাতক্ষীরা জেলার হাজারো মানুষ এখন ভারতের মাটিতে শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে আছেন। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে এ খবর নতুন করে জানানোর অবকাশ নেই।
আমরা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের সদস্যবৃন্দ ৮ এপ্রিল শ্যামনগর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের ৩য় তলায় সংবাদ সম্মেলন করে দেখলাম, তরুণ সাংবাদিকদের সকলের ভিতর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সকলেই সচেতন। মাহবুব উদ্দিন বাবু, বিজয় কুমার, শাহীন আলম, মনজুর হোসেনসহ সকলেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষ কিভাবে আগামী দিনগুলোতে বেঁচে থাকবে এ নিয়ে চিন্তিত। একজন সাংবাদিক বন্ধু বললেন, আমার গ্রামের বাড়ি কৈখালি। আমি শ্যামনগর শহরে বাস করি। রাতে ফোন আসলেই আতংকিত হয়ে যাই, বেড়িবাঁধ ভাঙার দুঃসংবাদ না তো?
উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের কোনো সংযোগ নেই। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিদের কাছে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কথা পৌঁছাতে পারে না।
বেড়িবাঁধ কেমন হবে? তলায় কত ফুট, আর উপরে কত ফুট হবে? উচ্চতা কত ফুট হবে? এসব নিয়ে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন গ্রামের হতে দরিদ্র স্বল্প শিক্ষিত মানুষ খুব সহজেই বলে দেন। কপোতাক্ষ বা খোলপেটুয়া নদীর পানির গতিপথ নিয়ে আলোচনা করে দেখা যায়, তাঁরা বলেন, এখানে শুধু বাঁধ দিলেই হবে না। এসব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বেড়িবাঁধ আরও তিন ফুট উঁচু করতে হবে। ব্লক দিতে হবে। বেড়িবাঁধের দুপাশে বনায়ন করতে হবে। তারপরও আপতকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য ইউনিয়নের ফান্ড থাকতে হবে। যাতে বিপদে পড়ার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারেন স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বাররা।
দুর্যোগ হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা ডিসি অফিস খবর পেয়ে দেখে যাবেন। ঢাকায় লিখবেন। প্রকল্প তৈরি করতে বলবেন। টাকা বরাদ্দ করা হবে। তারপরও টেন্ডার আহ্বান করা, —– এসব হতে হতে আমাদের অনেকেরই জীবনের শেষ হয়ে যাবে।
সেনাবাহিনীর কাজের ব্যাপারে মানুষের মাঝে স্বস্তি দেখা গেলেও এরপর কী হবে? এ নিয়ে আশংকায় আছেন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।
লেখকঃ মোঃ আনিসুর রহিম, আহবায়ক, সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি।
News Link: patradoot.net