সাতক্ষীরা প্রতিনিধি | প্রকাশিত ১৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:১০:০০
সাদা সোন খ্যাত চিংড়ি মূলত সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচ জেলায় উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদন হয়ে থাকে সাতক্ষীরা জেলায়। ইতিমধ্যে চিংড়ি শিল্প হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ঘেরে ভাইরাসের আক্রমানের পাশাপাশি বাজার সঠিক দাম না থাকায় চিংড়ি চাষে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জেলার চিংড়ি চাষিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরার ৬টি উপজেলার অর্ধলক্ষ হেক্টর জমিতে সাদা সোনা খ্যাত এই চিংড়ি চাষ করা হয়। বাগদা চিংড়ির পাশাপাশি গলদা ও হরিণা প্রজাতির মাছ চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বাগদা ও গলদা দেশের বাইরে রপ্তানি হয় এবং হরিণা চিংড়ি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। চিংড়ি রপ্তানি করে সাতক্ষীরা থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বৈদেশীক মুদ্রা অর্জিত হয়। কিন্তু চলতি ২০১৮ মৌসুমে চিংড়িতে ব্যাপক হারে ভাইরাস ও মড়ক দেখা দেয়ায় চাষিদের প্রায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে। একদিকে যেমন রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব, অন্যদিকে চিংড়ির দাম কমে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা। ফলে জেলার ছোট বড় অসংখ্য চিংড়ি চাষি পুঁজিপাট্টা হারিয়ে সর্বশান্ত হতে বসেছেন। চলতি মৌসুমে মড়কে প্রায় ১০০ কোটি টাকার উপরে চিংড়ি মাছ মরে গেছে। তবে জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘেরে পানি সল্পতা, পরিবেশ সম্মত না হওয়া এবং রেনু পোনা জীবানুমুক্ত না হওয়ায় ভাইরাস দেখা দিচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৮ মৌসুমে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলার ৪৯ হাজার ১৬৩টি নিবন্ধিত ঘেরে রপ্তানিজাত বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ২ হাজার ১০৫টি, তালায় ১ হাজার ২৯৫টি, দেবহাটায় ২ হাজার ৮২৯টি, আশাশুনিতে ১৩ হাজার ২১৭টি, কালিগঞ্জে ১৪ হাজার ৫৫৯টি ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫ হাজার ১৫৮টি ঘেরে রপ্তানিজাত বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষে নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। বিগত মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ হাজার মেট্রিকটন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার সরাপপুর গ্রামের বিশিষ্ট চিংড়ি চাষি রাজ্যেস্বর দাশ জানান, বিগত ৩০ থেকে ৩৫ বছর যাবত তিনি রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন করনে। চলতি মৌসুমেও ২ হাজার ৫০০ বিঘা পরিমাণ জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। তবে গত এক দশকের মধ্যে চলতি মৌসুমে চিংড়ি চাষে সর্বচ্চো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বলে জানান তিনি। রাজ্যেস্বর দাশ বলেন, চলতি বছর উৎপাদন শুরুর পর থেকে চিংড়িতে ব্যাপক হারে মড়ক লাগে। চিংড়ি গ্রেড হওয়ার কাছাকাছি এসেই ঘেরের মধ্যে মরে সয়লাব হয়ে গেছে। এতে অন্তত ২ কোটি টাকার উপরে লোকসান হয়েছে তার। তাছাড়া মৌসুমের শষের দিকে চিংড়ির ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বলে জানান তিনি।
চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার আবুল কালাম বাবলা জানান, চলতি মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার বিঘার ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। কিন্তু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘেরের অধিকাংশ চিংড়ি মরে গেছে। তিনি আরো বলেন, ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে চলতি মৌসুমে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে আরো প্রায় ১০০ বিঘা পরিমাণ পুকুরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। কিন্তু তাতেও মড়ক লেগে সমুদয় চিংড়ি মরে গেছে। এতে ১ কোটি টাকার মত ক্ষতি হয়েছে তার। তিনি আরো বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরে মড়ক লেগে যে পরিমাণ চিংড়ি মারা গেছে তার মূল্য কমপক্ষে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকার মত হবে।
সদর উপজেলার ফিংড়ি গ্রামের চিংড়ি চাষি ইউপি চেয়ারম্যান সামছুর রহমান, গোল্ডেন হোসেন ও জালাল উদ্দিন জানান, তারা প্রত্যেকে কম বেশি পরিমাণ চিংড়ি চাষ করেন। কিন্তু চলতি ২০১৮ মৌসুমে ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগবালাইয়ে ঘেরের চিংড়ি মাছ মরে যাওয়ায় তারা সমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে সামছুর রহমানের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। একই অবস্থা চাষি জালাল ও গোল্ডেন হোসেনের।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোঃ আব্দুর রব জানান, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। দুই মাস আগে যে চিংড়ি ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, তা এখন ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে চাষি ও ব্যবসায়ী উভয় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
বাংলাদেশ চিংড়ি চাষি সমিতির সাবেক সভাপতি ডাক্তার আবতাফুজ্জামান জানান, দেশের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরাতে বাণিজ্যিক ভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয় মূলত ১৯৭২ সালের দিকে। এর আগে তেমন ভাবে খুব একটা আগ্রহ ছিলো না সাধারণ চাষিদের। কিন্তু ৭২ সালের পর থেকে যখন এটি বিদেশে রপ্তানি’র চাহিদা বাড়তে লাগলো তখন থেকেই এ জেলার মানুষের মধ্যে চিংড়ি চাষে আগ্রহ বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, যখন প্রাকৃতিক উপায়ে রেনু পোনা সংগ্রহ করে ঘেরে চাষ করা হতো তখন চিংড়িতে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাগ ছিলো না। কিন্তু যখন থেকে কক্সবাজার ভিত্তিক হ্যাচারীতে উৎপাদিত পোনার উপর চাষিরা নির্ভর হলো তখন থেকেই চিংড়িতে নানা ধরনের রোগ বা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ শহীদুল ইসলাম জানান, এ জেলায় চিংড়িতে এতো বেশি ভাইরাস দেখা দেয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারন হচ্ছে ঘেরে পানি সল্পতা ও পরিবেশ সম্মত না হওয়া। জেলার অধিকাংশ ঘেরে ৩ ফুট পরিমাণ পানি থাকে না। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘের তৈরি করা হচ্ছে এখানে। তাছাড়া যে রেনু পোনা ঘেরে ছাড়া হয় তা সম্পূর্ণ জীবানুমুক্ত নয়। মৌসুম শেষে ঘেরের তলা (মাটি) ঠিকমত শুকানো হয় না। যে কারণে পরিবেশ সম্মত না হওয়ায় ঘেরে মড়ক বা ভাইরাস লেগে মাছ মরে যায়। তার পরও জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকার চিংড়ি চাষিদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে যাতে করে স্বাস্থ্যসম্মত চিংড়ি চাষ করা যায়।