এলাকাবাসী জানায়, সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখছে স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন লোকাল এনভায়রনমেন্ট ডেভলপমেন্ট এন্ড এগ্রিকালচারাল রিসার্স সোসাইটি (লিডার্স)। লিডার্সের উদ্যোগে এজন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। লিডার্সের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- পুকুর সংষ্কার ও পুকুরগুলিতে উন্নতমানের পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন, অচল পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) সচল করা, পিএসএফ ব্যবস্থাপনার জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে কমিটি গঠন, বায়োস্যন্ড ফিল্টার স্থাপন এবং কৃত্রিম ভাবে ভুগর্ভস্থা লবন পানির স্তওে মিষ্টি পানি পুনর্ভরণ ইত্যাদি। এ পর্যন্ত লিডার্স ১৮৯ বাঘ বিধবা পরিবারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি (রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেম) স্থাপন, ৫২৫০ পরিবারে বায়োস্যন্ড ফিল্টার স্থাপন, ১১ পুকুর খনন করে নতুন পি এস এফ স্থাপন, ২১ অকেজো পি এস এফ সচল করা ও ১০টি ভুগর্ভস্থ স্তর পুনর্ভরন(মার) টেকনোলজি স্থাপন করেছে যার মাধ্যমে প্রায় ১৫,৮৮১ পরিবারে সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগ তৈরী হয়েছে।
এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল জানালেন, কেবলমাত্র সুপেয় পানি সংকটের সমাধান নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপর্যস্থ স্বাভাবিক জনজীবন অধ্যুষিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় অভিযোজিত কৃষি, বিকল্প কর্মসংস্থান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বিভিন্ন পর্যায়ের গণমাধ্যমকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন, উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনা, এমনকি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের দক্ষতা উন্নয়নেও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে লিডার্স।
লিডার্সের প্রধান কার্যালয়
লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, সরকারের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে বাছাই করে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের স্থানীয় ঝুঁকি মোকাবেরায় প্রকল্প গ্রহনের জন্য দক্ষ করে তোলা, জলবায়ু ও দূর্যোগ সহনশীল ইউনিয়ন গঠনের লক্ষ্যে অভিযোজিত বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও জনসম্মুখে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। এরফলে জনগণ ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মধ্যে পারস্পরিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার মাধ্যমে এলাকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার উপযোগী উন্নয়ন গতিশীল হয়ে উঠছে। তিনি আরো বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের গণমাধ্যমকর্মীদের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশে দক্ষতা উন্নয়ন ও আগ্রহী করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এইসকল কার্যক্রম পরিচালনার ফলে এলাকার জনগণের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। অভিযোজিত কৃষির চর্চা, ধান ও সবজির উৎপাদন ও কৃষি ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি হওয়ায় প্রায় ১২০ একর জমি একাধিক ফসল উৎপাদনের আওতায় এসেছে। সরাসরি ভুর্গস্থ মৃদু লবন পানি ব্যবহার করে শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষে মানুষ সফলতা অর্জন করেছে। স্থানীয় দরিদ্র পরিবারগুলোর পারিবারিক আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সুপেয় পানি সংকট নিরসনের কারণে শ্রমঘন্টাও কয়েকগুন বেড়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ওই এলাকায় জলবায়ু বিপন্নতার পাশাপাশি রয়েছে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল (বনজীবীদের) বাঘের আক্রমণে অকাল মৃত্যুর ঘটনা। ফলে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের জীবনসঙ্গীদের স্থানীয়ভাবে ‘বাঘ বিধবা’ বলে ডাকা হয়। এলাকার অসহায় প্রায় ২ শতাধিক বাঘ বিধবা পরিবারের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তাদের পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতেও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন মুন্সীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক আনিসুর রহমান মল্লিক।
লিডার্সের প্রকল্প কর্মকর্তা রনজিৎ বিশ্বাস বলেন, লিডার্সের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রায় সাত শতাধিক কৃষক এবং প্রায় দুইশত জন বাঘবিধবাকে জলবায়ু অভিযোজিত ধান ও সবজি চাষের উপর প্রশিক্ষণ এবং ফলোআপ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে । প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব কৃষক পরিবারের মধ্যে লবন, খরা ও জলাবদ্ধ সহনশীল জাতের ৩২,১৫৫ কেজি ধানবীজ এবং রবি ও খরিপ মৌসুমে বিভিন্ন ১৩,৭৪৩ সবজি বীজ বিতরণ করা হয়েছে। প্রায় ছয়শত কৃষককে জৈব সার ও জৈব কীট নাশক তৈরির প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি জৈব সার তৈরির উপকরণ ও জৈব সার প্রদানকরা হয়েছে। লবন এলাকায় লবন সহনশীল ফলের বাগান স্থাপনের জন্য-১৪,২৮০ টি ফলজ বৃক্ষ বিতরন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকদের সহযোগিতায় ২০টি প্রর্দশনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি বছর বার্ষিক উদ্ভাবনী কৃষিমেলার আয়োজন করা হয়। দেশীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৪০টি বাড়িকে ‘বীজ বাড়ী’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত মোকাবেলা ও একফসলী জমিকে দুই বা ততোধিক ফসলের আওতায় আনতে লিডার্সের উদ্যোগে ৬৮ টি ধানের ক্ষেতে ছোট পুকুর, ২টি খাল পূনঃখনন ও ৫ টি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। কৃষকদের সহায়তার জন্য তৈরি করা হয় ফসল পঞ্জিকা। মাটি ও পানি পরীক্ষার জন্য একটি ল্যাবরেটরী স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে নিয়মিত মাটি ও পানির লবনাক্ততা ও গুনাগুণ পরীক্ষা করে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়।
লিডার্স-এর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট গ্রুপের সদস্য সিরাজ গাজী জানান, বেশ কয়েক দশক হলো জমিতে আগের মতো ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। এলাকার লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ আবহাওয়ারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। খরা, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ, জমিতে ফসল না হওয়া ইত্যাদি কারণে কর্মসংস্থানের অভাব তৈরি হয়েছে। অভাব-অনটনে অনেকে এলাকা ছেড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চল এমনকি দেশের বাইরেও পাড়ি জমাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে লিডার্স কাজ করছেন। এজন্য জলবায়ু অভিযোজিত কৃষির জন্য প্রায় আট শতাধিক কৃষককে নিয়ে মোট ৩৭টি ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট গ্রুপ, ৪টি সেল্প হেল্প গ্রুপ ২ টি কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে।
লিডার্স-এর কর্মসুচী কর্মকর্তা শওকৎ হোসেন জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের জীবন-জীবিকা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দাতা সংস্থা ‘ব্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর সহায়তায় লিডার্স সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় ৫টি ইউনিয়ন মুন্সীগঞ্জ, গাবুরা, কাশিমাড়ী ও বুড়িগোয়ালিনী এবং খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার ২টি ইউনিয়ন দক্ষিণ বেদকাশী ও উত্তর বেদকাশীতে “জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের জীবন-জীবিকা নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ” শীর্ষক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, দরিদ্র পীড়িত এই অঞ্চলের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জলবায়ু বিপন্ন দরিদ্র নারী প্রধান পরিবার চিহ্নত করা ও স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করা হয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় প্রতি মাসে ১৪টি ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক চিকিৎস্যা সেবা ও বিনা মূল্যে ঔষধ প্রদান করা হয়। এছাড়াও নারীদের চিকিৎসার জন্য বছরের বিভিন্ন সময় একাধিক বিশেষ ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিৎসা ও বিনা মূল্যে ঔষধ প্রদান করা হয়ে থাকে। শিশু, কিশোরী ও মায়েদের টিকা গ্রহন, গর্ভবতী মায়েদের সচেতনামূলক পরামর্শ, পুষ্টি ও হাইজিন বিষয়ক সচেতনা প্রদান করা হয় বলে জানালেন তিনি।
লিডার্সের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অসীত মন্ডল জানালেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বিকল্প কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় বাঘবিধবা সহ ৩৩০ নারীপ্রধান পরিবারকে বিভিন্ন ধরনের যেমন- ক্ষুদ্র ব্যবসা, পোল্ট্রী খামার, ছাগল পালন, সীট কাপড়ের ব্যবসা, মাছ চাষ, আটল পাটা তৈরি, দর্জি, আরিজরি, কারচুপী, হস্তশিল্প, জৈব সার প্রস্তুত, অভিযোজিত নার্সারী, কাঁচা মালামালের ব্যবসা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের আগ্রহ সৃষ্টির জন্য ১৬৮ নারী প্রধান পরিবারকে প্রায় ২২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাঘবিধবাদের নিয়ে গঠিত দুর্জয়, জাগ্রত, অনিবার্ণ ও অগ্রদূত নারী উন্নয়ন সংগঠনের(সেল্প হেল্প গ্রুপ) মাধ্যমে ১৬২ জন বাঘবিধবাকে ১৯ লক্ষ ৮২ হাজার লাখ টাকা অফেরতযোগ্য মূলধন হিসেবে প্রদান করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় লিডার্সের এই সকল কার্যক্রম ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলে জানান স্থানীয় সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দার। তিনি বলেন, জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে জনগণকে রক্ষায় সরকার ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী সংগঠনগুলোর এধরণের উদ্যোগ সারাদেশে গ্রহণ করা জরুরী। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বড় ধরণের ঝুঁকি মোকাবেলা সহজ হবে।
News Link: Click Here